শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

সংঘাতময় রাজনীতি ও জনপ্রত্যাশা

॥ আনোয়ারুল হক নিজামী ॥

১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ তথা প্রবাসী এবং বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র জাতিসংঘসহ বিশ্বনেত্রীবৃন্দ মনে করছে বাংলাদেশ অনিবার্য সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে কালোমেঘের ঘনঘটা, অনিশ্চয়তা, অসি’রতা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় ধেয়ে আসছে এক বিভীষিকাময় সময়। কখন কার জীবন প্রদীপ নিভে যায় কার অন্ধকার রাজনীতির বলি কে হয় কেউ জানে না। এমনি এক দুঃসহ দূর্দিনে কে দেখাবে আলোর পথ, কে আগামী দিনের একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেবে?

ক্ষমতাসীনদের কর্মকান্ড : ক্ষমতাসীনরা ড়্গমতার মোহে এতই অন্ধ হয়ে যান যে, বিরোধীদের দাবির প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা করে ‘৭৪ এর মতো কালো আইন নিজ নিজ সময়ে নিজেদের মতো করে আইন পাশ করে। জনগণ বিরোধীদের পক্ষে গিয়ে ব্যালটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাচ্যূত করে। এবার সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগে কেয়ার টেকার বিল রহিত করা হয়।

রাজনৈতিক সংঘাতে ধারাবাহিকতায় এবার দেশের অর্থনীতি চরম সংকটে পড়েছে। বিপর্যন- অর্থনীতির পাশাপাশি বিরূপ প্রভাব বিভিন্ন সেক্টরে, বিনিয়োগে স’বিরতা, কলকারখানায় উৎপাদন, গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিক অসনে-াষ, জনশক্তি রপ্তানী স’বিরতা, কূটনৈতিক ব্যর্থতা, আন-র্জাতিক ঋণ-মান প্রদানকারী সংস’া (মুডিস) ইনভেক্টর সার্ভিসের আশঙ্কা অবনতির।

সংকটে সুশাসনের অভাব, তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অদ্ভূত পরিসি’তি সর্বমোট ঋণমানের বড়ধরণের চাপ সৃষ্টি করবে। পোশাক শিল্পে দূর্ঘটনা বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা ড়্গুন্ন করেছে।

রাজনৈতিক সংঘাতে অর্থনীতি যেমন স’বির তেমনি বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

যেভাবে কেয়ার টেকার সরকার : ১৯৮০ সালের ১৮ই অক্টোবর ঢাকার রমনা রেসে-াঁরায় সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী মামলার এক আসামীর ফর্মূলা অনুপাতে কেয়ার টেকার সরকারের রূপরেখা উপস’াপন করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৫ই নভেম্বর বাইতুল মোকাররম উত্তর গেটে ঐ দলের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনসভায় প্রথম কেয়ারটেকার সরকার দাবি উপস’াপন করা হয়। কেউ কেউ পাগলের প্রলাপ বললেও একসময় কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারই প্রধান দাবিতে পরিণত করে বিরোধী দলের কাছে।

এরশাদের নির্বাচন : ৮বছর ৮মাস ১২দিন স্বৈরাচারী হোসেন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতাকালীন সময়ে স’ানীয় ও জাতীয় সকল নির্বাচন বিতর্কিত ভোটারবিহীন এবং জালভোটের উৎসবে পরিণত হত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫দলীয় জোট বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করলেও নির্বাচনে সফলতাল মুখ দেখেনি। ১৯৮৫ সালে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট একধরণের জালভোটের মহাউৎসবে পরিণত হয়। ১৯৮৬ সালের ৭ই মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বাদে জামায়াত-আওয়ামী লীগ এরশাদের জাতীয় পার্টির বিপক্ষে মাত্র ১০ ও ৭৬ আসনে জয়লাভ করে। এরশাদ ভোট ডাকাতি ও কারচুপির মাধ্যমে সেবার বিজয়ী হলে ‘৮৭ সালের নভেম্বরে বিরোধী দল সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে সংসদ ভেঙ্গে যায়। ‘৮৮ সালের ২রা মার্চ প্রধান বিরোধী দলহীন কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি (কপ) এর ২৩ দলীয় জোটের নেতা আ.স.ম. আব্দুর রবকে গৃহপালিত বিরোধী দলীয় প্রধান করা হয়। বিটিভি-কে সাহেব-বিবির গোলামের বাক্সে পরিণত করা হয়। ১৯৯০ এর ৬ই ডিসেম্বর গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটাই প্রধান হয়ে আসে। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘৯১ সালের ২৮ই ফেব্রুয়ারি প্রথম সফল নির্বাচন করে শিশু গণতন্ত্র উপহার দেন। ‘৯৪ মাগুরা-১ উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ইকোনো বলপেনের মালিক কামাল উদ্দিন ভোট কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত হন। মিরপুর উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী সৈয়দ মহসীন প্রভাব খাটিয়ে ভোট জালিয়াতের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। সেই থেকে তখনকার বিরোধী দল সুশীল সমাজ সর্বস-রের মানুষ কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে মুখ্য দাবিতে পরিণত করে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দ বিরোধী দলকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে নিরপেক্ষ বলতে কিছু নেই। হয় পাগল না হয় শিশু। পরে বিরোধী দলের আন্দোলন আরো চাঙ্গা হয়ে ১৭৩ দিনের হরতাল ২২ দিনের একটানা অসহযোগ আন্দোলন শুক্রবারসহ জুমার নামাজের জন্য ২ঘন্টা বিরতি দিয়ে আন্দোলন চলত। আন্দোলনের ফসল কেয়ারটেকার সরকার। ‘৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধীদলহীন প্যাড সর্বস্ব কিছুদল নিয়ে বিএনপি নির্বাচন করে মাত্র কিছুদিনের মাথায় কেয়ার টেকার বিল সংসদে পাশ করিয়ে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে পুণরায় নির্বাচন দেন। তখন বিএনপির দাবি ছিল কেয়ারটেকার সরকার বিএনপির ফসল।

একই বৃত্তে জাতি : সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সংসদে কেয়ার টেকার বিল বাতিল করে দেয় বর্তমান সরকার। বহু রক্তপাতের বিনিময়ে অর্জিত কেয়ার টেকার সরকারের দাবি নিয়ে পুণরায় রক্তপাত, হরতাল জাতির জন্য দূর্ভাগ্যজনক। ৯১-৯৬ বিরোধী দল যেমনি ধাক্কা আর ঝাঁকুনি দিয়ে সরকারকে ফেলে দেব হুমকি দিতেন আজকের বিরোধী দলও তিনমাস কিংবা ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম বার বার দিলেন। তখনকার বিরোধী দল বিদেশী দূতাবাসে চিঠি দিয়ে সরকারকে সহযোগীতা না করার আহ্বান জানিয়েছেন। আজকের বিরোধী নেতাও আমেরিকার ইংরেজী দৈনিকে প্রবন্ধ লেখার কারণে জিএসপি সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘৯১-‘৯৬ সালে যে রকম কালো আইন দিয়ে বিরোধী দলের উপর দমন নিপীড়ন করেছেন আজকের সরকারী দলও একইভাবে কালো আইন দিয়ে বিরোধী দল দমন করছেন। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও আমরা একই বৃত্তে ঘুরছি, ঘুরছে আমাদের স্বপ্নের স্বদেশ। এভাবে চললে-কবে আমরা মধ্য আয়ের দেশ হবো, কবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে সম্ভাবনার বাংলাদেশ!

সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি : ১৯৯৪ সালে ফিলিসি-নে গণহত্যার প্রতিবাদে সংসদে নিন্দা প্রস-াবের বিরোধীতা করে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা। বিরোধী দলকে উপহাস করে ‘অতি মুসলমান সেজেছে’ মন-ব্যে বিরোধী দল ক্রমান্বয়ে সংসদ বিমুখ হয়ে যায়।

লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী : সরকার প্রশাসন যন্ত্রকে ফুলের বাগানের মতো সাজিয়ে সরকারের অধীনে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে সরকারী দল জিতলে বিরোধী দল কোনো অবস’ায় মেনে নেবে না। যেমনি ২০০৭ সালে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা এ জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী অপরিহার্য। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না।

বিরোধী দলের অসহযোগীতা : প্রতিটি সংসদে বিরোধী দল অসহযোগীতা করে আসছে। এর জন্য সরকারী দলও নানাভাবে দায়ি। শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন।

সমঝোতার পথ : সংলাপ, সমঝোতাই কেবল অনিবার্য সংঘাত ঠেকাতে পারে। কূটনৈতিক মহলে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন দুই নেত্রীকে সংলাপে বসিয়ে সংঘর্ষ, সংঘাত ঠেকাতে। রাজনৈতিক সি’তিশীলতা ভেঙ্গে পড়-ক, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন হোক, উন্নয়ন অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়-ক, কোন সরকারেরই তা কাম্য হতে পারে না বলেই সংকট নিরসনে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। বল শেখ হাসিনা তথা সরকারের কোর্টে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস’া কী রকম হবে, বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা সরকারকেই করতে হবে।

চুলাচুলী : সংবিধান থেকে একচুলও নড়বোনা।” প্রধানমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বক্তব্যের জবাবে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়া- “এমন আন্দোলন শুরু হবে, আন্দোলনের বাতাসে সবচুল উড়ে যাবে।” ‘৯৬ সালের ভুলগুলি ২০১৩ সালের আওয়ামী লীগ পুণরাবৃত্তি করছে। সংবিধানের জন্য জনগণ, নাকি জনগণের জন্য সংবিধান? সংবিধান কি আল্লার কোরানের বাণী? এক বর্ণও পরিবর্তন হবে না। আগামী নির্বাচন অর্থবহ ও বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে রাজনৈতিক মতবিরোধ দ্বন্দ সংঘাত ভুলে সংলাপের পথেই চলতে হবে।

জাতির প্রত্যাশা : আরব বসনে-র ছোঁয়া বাংলাদেশে না লাগাতেই জাতি উপকৃত হলেও সরকারের আশেপাশে চাটুকার, দালাল, তোষামোদকারীরা হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিতে ব্যস-। যে কোন রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে সংলাপের বিকল্প নেই। আদালতের রম্নল, বিদেশী চাপ, যাই হোক না কেন জনগণের চাপ সবার উপরে। উভয় দলের শীর্ষ পর্যায়ে সংলাপে বসে রাজনৈতিক অঙ্গনকে সংঘাতমুক্ত রাখতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস’ার কোন বিকল্প নেই। নির্বাচনের স্বার্থে দুই দলের রাজনৈতিক  সমঝোতার মধ্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সি’তিশীল সরকার কায়েম করে আগামী দিনে এশিয়ার টাইগার সম্ভাবনার বাংলাদেশ দিগনে-র পতাকা উড়বেই বাংলাদেশের আকাশে এই প্রত্যাশাই আপামর জনগণের।

Leave a Reply