বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে চাপ দিন : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করে তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ।

রোববার ঢাকায় ৬৩তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্সের (সিপিসি) উদ্বোধন ঘোষণা করে এ কথা বলেন সিপিএ- এর ভাইস প্যাট্রন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সকালে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবার সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘কনটিনিউয়িং টু এনহ্যান্স হাই স্ট্যান্ডার্ডস অব পারফরমেন্স অব পার্লামেন্টারিয়ানস।’

৫২টি দেশের ১৮০টি জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্যসহ প্রায় সাড়ে পাঁচশ প্রতিনিধি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সংসদীয় ফোরাম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।

রোববার সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও এবার সিপি কনফারেন্সের কার্যক্রম শুরু হয় গত ১ নভেম্বর। ঢাকার হোটেল র‌্যাডিসনে ২ থেকে ৪ নভেম্বর সিপিএ- এর বিভিন্ন অঞ্চল, কমনওয়েলথ উইমেন পার্লামেন্টারিয়ানস এবং নির্বাহী কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

রোববার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রেই সম্মেলনের সাধারণ সভা, বিভিন্ন গ্রুপের মিটিং ও আটটি কর্মশালা হবে। সিপিএ- এর নতুন চেয়ারপারসনও নির্বাচিত করা হবে এ সম্মেলনে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অমানবিক নির্যাতন এবং তাদের জোরপূর্বক বিতাড়িত করে দেওয়া শুধু এ অঞ্চলে নয়, এর বাইরেও অস্থিরতা তৈরি করছে।’

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের এই নির্যাতনমূলক আচরণের ফলে সেখান থেকে ৬ লাখ ২২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে আরো প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাময়িকভাবে আমরা এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছি। আপনাদের অনুরোধ জানাব, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করুন। মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করুন।’

রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রকৃত কারণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা প্রস্তাবও তুলে ধরেন। বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, রোহিঙ্গা সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।

অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে আমাদের সরকার সব সময়ই কাজ করে যাচ্ছে। এর ফলে আমরা ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি এবং স্থল সীমানা চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করতে পেরেছি। একইভাবে মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। জাতীয় সংসদ, বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকারসহ আমরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেছি।’

তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অতন্দ্র প্রহরী স্বাধীন এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের (গণমাধ্যম) অবাধ স্বাধীনতা। মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ দায়িত্ব পালন করছেন। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনে আমাদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যে আমরা রূপকল্প- ২০২১ প্রণয়ন করি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমরা আমাদের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’

শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং পরে নিজের নির্বাসিত জীবনের কথাও তুলে ধরেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের কথাও স্মরণ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এমডিজি বাস্তবায়নের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আমরা এসডিজি বাস্তবায়ন করছি। আমাদের চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এসডিজির বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে।’

জলবায়ু বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। এ বছর অতিবৃষ্টিসহ কয়েকবার বন্যায় আমাদের বিশাল জনপদ ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য যেসব সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি।’

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রে এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও প্রতিষ্ঠানকে আরো শক্তিশালী করা এবং এসব রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা তৈরি করা।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে সিপিএ- এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সিপিএ- এর নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

বিশ্বব্যাপী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংসদ সদস্যগণের প্রদত্ত এই স্বীকৃতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ও মূল্যবোধের স্বীকৃতির একটি প্রামাণিক দলিল বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এই পৃথিবীকে বিশ্ববাসীর জন্য সুখময়, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাসভূমিতে পরিণত করার আহ্বান জানিয়ে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্সে বিদেশি সদস্যদের বাংলাদেশে অবস্থান আনন্দময় এবং এ সম্মেলন ফলপ্রসূ হোক- এ কামনা করেন।

প্রসঙ্গত, কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন যাত্রা শুরু করে ১৯১১ সালে। আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, কানাডা, ক্যারিবিয়ান আমেরিকা ও আটলান্টিক, ভারত, প্যাসিফিক ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া- এই আটটি অঞ্চল নিয়ে সিপিএ গঠিত।

বাংলাদেশ এ ফোরামের সদস্য পদ পায় ১৯৭৩ সালে। সিপিএ- এর ৬২তম সম্মেলন গত বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় হওয়ার কথা থাকলেও জুলাই মাসে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার কারণে তা আর হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী সিপিসি- এর ৬৩তম সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণার পর বিশেষ ডাকটিকিট ও খাম অবমুক্ত করেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিএ- এর চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে তিনি এই ফোরামের প্যাট্রন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবন এবং সিপিএ- এর কার্যক্রম নিয়ে দুটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।