বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

বিলুপ্তির পথে এখন সকাল বেলার মক্তব শিক্ষা

01,17

নাছির উদ্দিনঃ   ভোর বেলায় আরামের ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে পবিত্র হয়ে আরবী শিক্ষা আহরণের জন্য মক্তবে যায়নি এরকম লোক মুসলিম সম্প্রদায়ে খুবই কম পাওয়া যাবে। একটা সময় ছিলো মুসলিম ধর্মালম্বীদের জন্য আরবী শিক্ষার অন্যতম ভান্ডার এই মক্তব শিক্ষা। যেখান থেকে প্রতিটি শিশু কিশোর কালিমা, কোরান তেলাওয়াত, নামাজ শিক্ষা ও নৈতিকতার শিক্ষা অর্জন করেছে। আর এই চাহিদা পূরণে মক্তব শিক্ষার গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। ধনী গরীব ভেদাভেদ ভূলে ভোর বেলায় ফজরের নামাজ আদায়ের পর সূর্য্যি মামার রাঙা আলোয় ভূবন যখন লালিমা আভায় ফুটে উঠে। চিক চিক করে যখন রোদেলা সকাল পূবাকাশে উঁকিদেয়। ঠিক তখনি কাক ডাকা ভোরে মায়ের আলতো ভালোবাসার বকুনি শুনে আরামের নিদ্রা ত্যাগ করে বিছানা ছাড়তে হতো শিশু কিশোরদের। এরপর শুরু হয় মায়ের কাছে বিভিন্ন বায়না। তবুও পবিত্র হয়ে মায়ের আদেশ মত মক্তবে যেতে হতো। এদিকে মক্তবে যাওয়ার পর বয়স অনুযায়ী মৌলভী সাহেব উপস্থিত সবাইকে আলাদা আলাদা বসাতেন। বয়স অনুযায়ী দলভাগ করে দিতেন। একেবারে ছোটদের মুখে মুখে কালিমা শিক্ষা পড়াতেন। তার থেকে বড়দের কাউকে কায়দার মাধ্যমে আরবী হরফ শেখাতেন। এর সাথে যবর, যের, পেশ, তাশদীদ, যযম, যুক্ত বর্ণ ও বানান শেখাতেন। আবার কাউকে আমপারা (কোরান শরীফের কয়েকটি সূরা সংবলিত) বানান ও মতন শেখাতেন। এরা যখন আমপারা বানান এবং মতন পড়তে পারে তখন তাদের কোরান শরীফ সবক দিতেন। ক্রমান্বয়ে তারা এক একটি আয়াত, সূরা, পারা শেষ করে কোরান শরীফ খতম করতেন। তার পর মক্তব শিক্ষার সমাপ্তি হতো তাদের জীবন থেকে। আর এর জন্য কারো ৩-৫ বছর আবার কারো ৫-৭ বছর লেগে যেত।

প্রতিদিন মক্তব শুরু হলে মৌলভী সাহেব ঘুরে ঘুরে সকল দল থেকে পড়া শুনতেন এবং যারা পারেনা তাদের পড়া বুঝিয়ে দিতেন। ক্রমান্বয়ে ছোটদের কালিমা শিক্ষা হলে কায়দা দিতেন, তারপর আমপারা, তারপর কোরান শরীফ সবক দিতেন। এভাবে প্রতি শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত পাঠদান করা হতো একই নিয়মে। পরদিন বৃহস্পতিবার সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে কালিমা, সুরা ক্বেরাত, নামাজের নিয়ত ক্রমান্বয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা শেখাতেন। এক্ষেত্রে যে ভালো পারে তাকে ইমাম হিসেবে সামনে দাঁড় করিয়ে মৌলভী সাহেব একপাশ থেকে তাদের নামাজ আদায় করা দেখতেন। কোথাও কোন ভুল ধরা পড়লে তিনি সাথে সাথে সেটা বুঝিয়ে দিতেন। এছাড়াও যখন কোন শিক্ষার্থী প্রথমে কায়দা সবক নেবে তখন মক্তবের সবাইকে জিলাপি বা বিস্কটু তবারক হিসেবে বিতরণ করার রেওয়াজ ছিলো। আর মৌলভী সাহেবকে হাদিয়া স্বরুপ কিছু টাকা দেয়া হতো। আবার আমপারা ও কোরান শরীফ সবক নেয়ার সময়ও ঠিক একই ভাকে তবারক ও হাদিয়া দেয়ার রেওয়াজ ছিলো। মক্তব শিক্ষা প্রদানের জন্য মৌলভী সাহেবকে সামান্য কিছু মাসিক হাদিয়াও দেয়া হতো। আর এভাবে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছিল মক্তব শিক্ষা কার্যক্রম। আবার অনেকে ধনী পরিবারে সন্তানদের মক্তব শিক্ষার জন্য আলাদা করে মৌলভী রাখতেন। যিনি শুধু ওই বাড়ীতে যে সকল শিশু কিশোররা থাকবে তাদের পড়াতেন। যে চির চেনা সকাল বেলার মক্তব শিক্ষার কথা অনকেরই এখনও মনে পড়ে। স্মৃতির পাতায় এখনও অপকটে দাগকাটে সেই সকাল বেলার মধুর সূরে আওয়াজ করে কোরান তেলাওয়াত করার ইতিহাস।

এদিকে ঐতিহ্যবাহি এই মক্তব শিক্ষা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামীণ পরিবেশে ঠাঁই করে নিয়েছে কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা কার্যক্রম। যাদের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৭ টা, ৮ টা কিংবা ৯ টা থেকে। যার ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সকাল বেলায় ঘুম থেকে তুলে মক্তবে পাঠানোর পরিবর্তে নাস্তা খাইয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের ওই কোমলমতি সন্তানদের এখন আর সকাল বেলার মক্তব শিক্ষা থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছেন। ইচ্ছে তাকা সত্ত্বেও অনেক অভিভাবক প্রতিযোগিতার এ যুগে আরবী শিক্ষাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। তাই এখন আর কচি কাচা শিশু কিশোরদের সকাল বেলার মধুর সুরে কোরান তেলাওয়াতের আওয়াজ শোনা যায়না। এক সময় যেখানে প্রতিটি মক্তবে ৫০-৬০ জন শিশু কিশোরের কলকাকলিতে মুখরিত ছিল মক্তব প্রাঙ্গণ সেখানে এখন সব মিলিয়ে ৮-১০ শিশু কিশোরদের দেখা মেলে। তাও যারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।

এদিকে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে শিশু কিশোরদের মক্তব ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলেও তা অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শুধু মক্তবের সামনে একটি সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে রাখা হয়েছে। আর মৌলভী সাহেবের জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃক মাসিক বরাদ্ধকৃত টাকা গুলো তিনি গ্রহণ করছেন। এ বিষয়ে কতিপয় মৌলভীগণ বলেন, অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের সকালে মক্তবে না পাঠায় তাহলে আমরা কি করব। যারা আসে তাদের আমরা সঠিকভাবে প্রতিদিন পাঠদান করে আসছি।

এ বিষয়ে এলাকার কতিপয় প্রবিণ ব্যক্তি বলেন, একটা সময় ছিলো যখন আমরা ছোট বেলায় মক্তব থেকে আরবী শিক্ষা গ্রহণ করেছি এবং আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এই শিক্ষা গ্রহণ করে ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুকরন অনুসরন করে সেই মোতাবেক পালন করে আসছি। কিন্তু এখন আমাদের সন্তানদের সেই শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত করছি। কারণ আমরা এখন যুগের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে আকাশে উড়ার চেষ্টা করছি। যার জন্য যে সময়ে আমরা সন্তাদের মক্তবে পাঠাব সেই সময়ে এখন স্কুলে পাঠাতে হচ্ছে। আমরা তাদের আখেরাতের শিক্ষার্জন থেকে বঞ্চিত করছি।