বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ফিরিয়ে দাও সকল উৎসব : পিউলি খাতুন


আমরা সদ্য পার করে এসেছি ঈদ-উল-ফিতর। প্রতি বছরের মত খুশী জোটেনি এবার। এই ঈদে খুশী খুঁজে নেওয়ার মত মানসিকতাও ছিলনা কারোর।
প্রতি বছর রমজান শুরুর সাথে সাথেই প্রতিদিন ইফতারের সময় গোনা হয় – আজ চারটে রোজা,কাল পাঁচটা,পরশু ছ’টা…. এই করে করে একদিন আসে সাতাশ রোজা, বিশেষ দিন। এই সাতাশ রোজার সারারাতের নামাজের পর একটা ঈদ – ঈদ গন্ধ নেমে আসে মহল্লায়।
এ বছর সাতাশ রোজার সমবেত নামাজ বা ঈদের গন্ধ কোনোটাই ছিলনা; ছিলনা চাঁদ ওঠার খবরের অপেক্ষা বা অপেক্ষার আনন্দ। আবার ও আসলো ঈদুল আযহা। সমস্ত অশুভকে কোরবানী করে নতুন করে আলো জ্বালানোর উৎসব।
এবারও চাঁদ রাত হবে বটে, কিন্তু চাঁদরাতে দল বেঁধে মেয়েদের মেহেন্দী পরাটা বোধ হয় আবারও হবেনা; মায়েদের আগের দিন থেকে রান্নার জোগার করতেও দেখতে পাবনা হয়তো। একমাস আগে থেকে ঈদের বাজার, দর্জির দোকানে জামা বানানোর লড়াই,ম্যাচিং জুতোর জন্য পরিবার শুদ্ধ শপিংমল; নাহ্, কোনোটাই হয়নি এবার। এ বছর ঈদের দু’দিন আগে গোবিন্দভোগ চাল, লাক্চা শিমুই বা শুকনো শিমুই কেনার হুটোপাটা একদমই ছিলনা; কোরবানী ঈদেও তা থাকবেনা অনেক আয়োজনই, সম্ভব নয়। বাজারে ঈদ স্পেশাল ড্রাই ফ্রুটস, চাল কোনো কিছুর জোগান হচ্ছেনা আগের মত।
দু-দুটো “ঈদ”। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে বাঙালীর উৎসব দুটো অতিক্রান্ত হচ্ছে, ঠিক যেমনভাবে ঘরবন্দী হয়ে কেটেছিল পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়া। পয়লা বৈশাখে নতুন জামা পরে হালখাতা করা হল না, বাঙালীকে এটাও মেনে নিতে হয়েছিল। ঈদ – দুটোও এ বছর তেমনই। আগের দিন থেকে মসজিদে ঘোষণা হবেনা কটা’র সময় নামাজ হবে, ঈদের সকালে মহল্লা জুড়ে দল বেঁধে বাবা-দাদারা নামাজ পড়তে যাবেনা, কোলাকুলি তো দূর কি বাত। মা-বোনেরা ঈদের শাড়ি গয়না পরে পাড়ায় কারোর ছাদে একসাথে নামাজ পড়ার পর সবথেকে ভালো শাড়ি বা সব থেকে ভালো গয়নার মজার বিচার সভা বসাবেনা কোথাও। বাচ্চাগুলো নতুন জামার ভার সামলে রাস্তায় ছুটবে না এবার, নামাজের পরের মিষ্টির জন্য হা-পিত্যেশ করার সুযোগই পাবেনা ওরা।
এবারের ঈদ দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসা নামাজের সুর, এবারের ঈদ ও বাড়ি বাড়ি থেকে বেরোনো লকডাউন ঘিয়ের সুবাস, এবারের ঈদ জমায়েতহীন কোয়ারান্টইন নামাজ, এবারের ঈদটা বাড়ি বাড়ি যাতায়াতহীন এবং দূর থেকে আস্ সালাম ওয়ালেকুম্ ও ঈদ্ মুবারক্ বলার। এবারের ঈদ হোক মানুষের পাশে মানুষ থাকার প্রতিশ্রুতি, পৃথিবী বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি, বাংলা হাসানোর প্রতিশ্রুতি। এবারের ঈদ আল্লাহর কাছে মোনাজাত করার । এ দুনিয়াকে তুমি সুস্থ করো, কোরোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করো, গৃহহীনকে ঘর ফিরিয়ে দাও তুমি, ক্ষুধার্তকে খাবার জোগাও।
সামনেই দূর্গাপূজো। ঈদে এক বন্ধুর বাড়িতে অন্য বন্ধুদের শিমুই,মাংস, রুটি না খাওয়ার দুঃখটা যেন বিজয়া দশমীতে কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে নাড়ু নিমকি খাওয়ার আনন্দে ভুলে যেতে পারি আমরা। এটাই প্রার্থনা। কারণ, বাঙালী অত ধর্ম বোঝেনা, বোঝেনা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বাঙালীর অন্যতম ধর্ম খাওয়া, অন্যতম উৎসব প্রিয় স্বজনকে খাওয়ানো। আসল বাঙালী কবেই বা হিন্দু-মুসলিমের হিসেব কষল ? তার থেকে কষা মাংসতেই বাঙালীর উৎসাহ বেশী। তাই ঈদ হোক বা পূজো, হে সর্বশক্তিমান, আমাদের অন্তঃত একটা পার্ব্বণে মোচ্ছব করতে দিও প্লিজ। কথা দিচ্ছি, তোমার সন্তান পৃথিবীকে আর জ্বালাব না আমরা।
পৃথিবী, আমাদের নতুন কিছুই চাইনা আর; আমাদের পুরোনো পয়লা বৈশাখ, পুরোনো ঈদ, পুরোনো পূজো ফিরিয়ে দাও; ফিরিয়ে দাও আমার অতি পরিচিত চেনা পৃথিবী, চেনা তুমি। আমাদের সুস্থ করো।

পিউলি খাতুন, কবি প্রাবন্ধিক, কলকাতা থেকে