বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

পথচারীদের জরিমানা এবং অজ্ঞতার মায়া কান্না

4


রাজধানীতে যত্র-তত্র রাস্তা পার হওয়া যাত্রীদের জরিমানা করছে ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ। এই সংবাদটা নিয়ে পত্রিকা গুলি বেশ সরগরম। এক্ষেত্রে কিছু কলামিস্ট এর কলামও পথচারীদের পক্ষে জোরালো ভুমিকা রাখছে দেখলাম। এটা জরুরী এবং স্বাভাবিক। আমরা যারা কলাম লিখি তারা নয় শুধু, যারা সংবাদ কর্মি আছেন তারা প্রত্যেকেই সাধারনের বন্ধু। সমাজের হিতৈষী। আমিও এর ব্যাতিক্রম না। তবে এ ক্ষেত্রে পথচারীদের পক্ষে থাকার চেয়ে কেন জানি আমার মনে হচ্ছে পথচারীদের ভুল গুলিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে ঐ সমস্ত লেখা। আমি স্বীকার করছি আমাদের দেশের রাস্তার দুর্দশার কথা। চালক ও ট্রাফিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কথা। মন্ত্রী-মিনিস্টারদের যাতায়াতের নামে গাড়ি ও পথচারীদের হয়রানির কথা। কিন্তু তাই বলে কোন শুভ উদ্দ্যোগ কে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে আমি নেই।ছোট্ট একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো-একদা রাস্তা পার হতে গিয়ে এক ভদ্রলোক একটি গাড়ির ধাক্কা খেয়ে ড্রাইভারের উপর ক্ষেপে গিয়ে বললেন- কানা নাকি ? দেখে গাড়ি চালাতে পারনা ? উত্তরে চালক বললেন- আরে বাবা দেখে চলবে তো। একেবারে গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লে আমার কি করার আছে ? যাত্রীটি আরও ক্ষেপে গিয়ে বলল- হুম—আমাকে চলা শিখা হচ্ছে, বলি এই রাস্তায় হাঁটছি আমি আজ ত্রিশ বছর ধরে। বলতে পারো এই রাস্তায় ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা। এবার চালক ও কম যান না। চালক বলল- ভাই এই রাস্তায় আমিও ত্রিশ বছর গাড়ি চালাচ্ছি। বলতে পারো আমারও ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। আমরা যারা ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সুন্দর-অসুন্দরকে একই পাল্লায় মেপে থাকি। অনেকে লিখেছেন বিশ্বের কোথাও এমন নেই। আমি বিনয়ের সাথে তাঁদের বলবো, বিশ্বের অনেক জায়গায় আছে এই জাতীয় মোবাইল কোর্টে জেল-জরিমানার দৃষ্টান্ত। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বানিজ্য রাজধানী দুবাইর বৃহৎ শিল্প এলাকার নাম ‘আল কুওজ’। নব্বইয়ের দশকেও এই আল কুওজ ছিল বিরান ভুমি। বর্তমানে সেই আল কুওজ এ বেশ কয়েকটা শপিং মল। প্রচুর ট্রাফিক সিগন্যাল। প্রতিটি সিগন্যালে লোক পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং আছে। শিল্প এলাকা হওয়ায় সন্ধ্যায় বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। সেখানে যত্র-তত্র মানুষ রাস্তা পার হতে গিয়ে কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটার পর পুলিশের মোবাইল কোর্ট বসে একদিনে শতাধিক লোককে জরিমানা করা হল। সেই জরিমানাটার ধরন কেমন ছিল জানেন ? আইন ভঙ্গকারী প্রতিটি লোককে মাত্র পঞ্চাশ দেরহাম(প্রায় ১০০০ টাকার কিছু বেশি) জরিমানা করে তাদের পরিচয় পত্র নিয়ে একটা রশিদ ধরিয়ে দিয়ে বলা হল এই জরিমানা দুবাই মিউনিসিপ্যালীটিতে প্রতিদিন এক দেরহাম করে জমা করে পঞ্চাশদিন পর নিজের পরিচয় পত্র নিয়ে আসতে। আল কুওজ থেকে সেই মিউনিসিপ্যালিটী অফিসের দুরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। অর্থাৎ এক দেরহাম জমা করতে প্রতিদিন দশ দেরহামের পেট্রোল জ্বালাতে হবে। নতুবা ১০/২০ দেরহাম গাড়ি ভাড়া দিতে হবে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়, প্রতিদিন আপনি কর্মস্থল থেকে ছুটি নিবেন কি ভাবে ? এই জরিমানার পর ঐ এলাকায় এতোটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে যে আর কোথাও দেখা যায়না মানুষ যেখানে সেখানে রাস্তা পার হতে ফলে দুর্ঘটনা শুন্যের কোটায়। বাংলাদেশে এই ধরনের জরিমানা করা হলে আমার মনে হয় পরেরদিন থেকেই হরতাল অবরোধ ভাংচুর শুরু হয়ে যাবে। অথচ এই দেশে আইনকে সবাই শ্রদ্ধা করে। আর এই জন্যই এই দেশ এতো উন্নত। বাংলাদেশে দুর্ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থল থেকে ড্রাইভার ও তার সহকারী পালিয়ে যায়। কারন জনরোষে তাদের মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা থাকে। গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আর বিদেশে ? এখানে দুর্ঘটনা ঘটলে পাবলিক ঐ গাড়ির কাছে যেতে পারবেনা। পুলিশকে ফোন করা হয়। সব দায়ীত্ব পুলিশের। এ্যাম্বুলেন্সের দরকার পড়লে পুলিশের এ্যাম্বুলেন্স আসবে। প্রয়োজনে হেলিকপ্টার আসবে। পুলিশ এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গাড়ি বানানোর জন্য ইনস্যুরেন্স পেপার দেবে। ড্রাইভারের দোষ হলে তাকে জরিমানা করা হবে। কোন লোক নিহত হলে ড্রাইভারকে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তার উপর মামলা হবে। সুতরাং পাবলিকের এখানে নাক গলানো একেবারেই অসম্ভব। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বলবো, আইন-শৃঙ্খলার অবনতির সমালোচনা করবো অথচ প্রশাসনের ভালো পদক্ষেপ গুলোরও সমালোচনা করবো তাতো হওয়া উচিৎ না।এই আইন-কানুন,জেল জরিমানা সবই পথচারী ও যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যই বিদেশে করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও একই কারনে করা হচ্ছে বলে আমাদের বিশ্বাস। জরিমানা কাকে করা হয় ? যে আইন ভঙ্গ করে তাকে। নিশ্চয় পুলিশ বেকসুর কাওকে জরিমানা করেনি। যারা আইন ভঙ্গ করেছে তারা অপরাধী। আর অপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া কোন বিবেকবান মানুষের পক্ষে সম্ভব না। এক্ষেত্রে কি ভাবে দুর্ঘটনা হ্রাস করা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া যায়। পরিবহন মালিক, যাত্রী ও পথচারীদের স্বার্থ রক্ষা সমানভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে।আমাদের দেশের রাস্তাগুলি অপ্রশস্ত, তার উপর হকার কর্তৃক অবৈধ দখল। এখানে পথচারীদের কে জরিমানার পুর্বে কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল বলে আমার মনে হয়।

আর তা’ হলো- ১, পথচারীদের পারাপারের জন্য নির্মিত আন্ডার পাস ও ফুট ব্রিজ গুলোকে পথচারী চলাচলের উপযোগী করে তোলা। সকল অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য সি সি টি ভি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষনিক মনিটর করার ব্যাবস্থা করা।
২, যত্র-তত্র দাড়িয়ে যে গাড়িগুলি যাত্রী উঠা-নামা করে সেই গাড়ি গুলিকে জরিমানা
করা। এবং যত্র-তত্র পার্কিং করা গাড়ি গুলিকে জরিমানা প্রদান করা।
৩, পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং এবং বিশেষ এলাকা গুলিতে যেমন হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা,হাসপাতাল গুলির সামনে জেব্রাক্রসিং এর দশ মিটার পুর্বে স্পীড ব্রেকার এবং প্রতি তিনশ মিটারে একটি জেব্রাক্রসিং দিলে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে।
৪, রাস্তাগুলিতে যথাযথ ট্রাফিক সাইন স্থাপন এবং রোড মার্কিং করা।
৫, সবশেষে জরিমানার পুর্বে গনমাধ্যমে তা ব্যাপক ভাবে প্রচারনার প্রয়োজনীয়তা ছিল।
এছাড়া আমাদের ট্রাফিক পুলিশকে ঢেলে সাজানোটাও সময়ের দাবি। আশির দশকের মাঝামাঝিতে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন উপলক্ষে বি টি ভি’র একটি সংবাদ চিত্রে দেখলাম, সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে ডিউটি রত এক সার্জেন কে জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা এই ট্রাফিক সপ্তাহে আপনারা গাড়িগুলির কি কি চেক করেন ? সানগ্লাস পরা সার্জেন টি বললেন- আমরা সাধারনত গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট গুলি চেক করি। সাংবাদিক এবার বললেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট বলতে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন ? সার্জেন কিছুক্ষন চিন্তা করে বললেন-ফিটনেস সার্টিফিকেট মানে হল, সার্টিফিকেট অব ফিটনেস। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম সেই আশির দশকে।এখন সময় কিছুটা পাল্টেছে। আশা করি সেই পরিস্থিতি আর নেই। ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করতে গেলে নাকে একটু-আধটু গন্ধ লাগবেই। তাই বলে পরিস্কার করা থেকে বিরত থাকতে নেই।

 

এস,এম,মনসুর নাদিম।
প্রবাসী সাংবাদিক কবি ও কলামিস্ট।