বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

জাতি ও চিন্তাচর্চায় গ্রন্থাগার

ali-237x300

কবি আলী প্রয়াস:::::::

জ্ঞানের উৎস বই। আর বইয়ের উৎস গ্রন্থাগার। মানুষের জ্ঞান-সমৃদ্ধির কেন্দ্রস্থল এটি। মানুষকে পড়ার প্রতি আগ্রহী, স্বশিক্ষিত এবং রুচিশীল    করে তোলে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা স্কুল-কলেজের চেয়ে বেশি।’ কারণ এটি একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠান এবং এটা মানুষের মধ্যে সামাজিকতা, নৈতিকতা, অধিকার ও কর্তব্যবোধ, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা ও কুসংস্কারের বিপরীতে সুষ্ঠু মানসিকতা গঠনে ভূমিকা রাখে। মোটকথা, কোনো জাতি গঠনের ক্ষেত্রে লাইব্রেরির ভূমিকা অসামান্য।

একটি জাতির চিন্তাচেতনা কেমন হয় তা নির্ভর করে মূলত সেই জাতির জ্ঞানচর্চার উপর। যদি সে জাতি যুদ্ধবিষয়ক জ্ঞান লাভ করে তবে অন্য কোনো রাষ্ট্রের জন্য সেটা ভীতিকর হয়ে ওঠে। আর যদি সেই জ্ঞান হয় আনন্দময় তবে সেই জাতি অন্য দেশ বা রাষ্ট্রের জন্য হয়ে ওঠে একটি পড়শি পুণ্যদেশ। চিন্তার ক্ষেত্রে আগে থেকেই বই বা পুঁথি ভূমিকা রেখে আসছে। প্রাচীনকাল থেকেই পুঁথি সংরক্ষণের প্রথা ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিহারে বহু প্রাচীন পুঁথি পাওয়া গেছে। মধ্যযুগে বাংলার হোসেন শাহি রাজবংশ সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য খ্যাতিলাভ করে এবং তারা রাজকীয় গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিল। ১৭৮০ সালে শ্রীরামপুর মিশন কর্তৃক প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রন্থাগার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অঙ্গের মতো। বই জ্ঞানের প্রতীক। আনন্দের প্রতীক। মানুষের অন্তরাত্মাকে সমৃদ্ধ করে। জ্ঞানকে বিকশিত করে। আর বইয়ের আধার পাঠাগার। একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য যেমন করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দরকার আছে, তেমনি ঐ জাতির মননশীলতার উন্নয়নের জন্য দরকার গ্রন্থাগার। গণগ্রন্থাগার সকলের। সীমাহীন গ-ী নিয়ে এর উৎপত্তি ও বিকাশ। বিশেষ করে আধুনিক গণগ্রন্থাগার সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের অভিভাবক। তাই দেখা যায় শিশুকিশোরদের মানস গঠন থেকে আরম্ভ করে জাতি গঠনের সকল স্তরে সকল প্রকার সেবা বিতরণে গণগ্রন্থাগার উদারহস্ত। সে জন্য গণগ্রন্থাগারকে জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়। বলা যায় জাতির বিশ্ববিদ্যালয়।

দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষায়, সমাজ ও জাতি গঠনে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। ব্যক্তির চিন্তাধারা বিকাশে, অবসর মুহূর্তে বিনোদনের হাজারো লোকের উপকারে ব্রতী এই গ্রন্থাগার। শিক্ষার্থীরা গণগ্রন্থাগারে আসে, বই পড়ে। তাদের কাছে গ্রন্থাগার এমন একটি তীর্থস্থান যেখানে ক্লাসের পড়া শেখা যায়, শিক্ষক মহোদয়ের দেওয়া এসাইনমেন্ট করা যায়। পাঠক্রমের বাইরের বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করা যায়। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত জনগণ তাদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হলে, গবেষক গবেষণার তথ্যের অসামঞ্জস্য বোধ করলে তথ্যাবলীর জন্য এখানে আসেন।

গ্রন্থাগার সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষা অর্জনকে পূর্ণতা দানে সহায়তা করে। পাঠক ব্যবহারকারীর জ্ঞান অর্জন, স্বশিক্ষা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন, তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা এবং সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানই গ্রন্থাগার আমাদের দেশে বিভিন্ন শেণির গ্রন্থাগার রয়েছে। এগুলো জাতি ধর্ম বর্ণ পেশা, বয়স নির্বিশেষে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সমাজের সকল স্তরের নাগরিকের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, ধর্ম, ভাষা, বিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের পুস্তক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে এবং সেগুলো জনগণ উন্মুক্তভাবে ব্যবহার করে জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করতে পারে।

শিক্ষা তিন উপায়ে গ্রহণ করা যায় — আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা উত্তীর্ণের মাধ্যমে একাডেমিক সনদ দেয়া হয়ে থাকে। অনানুষ্ঠানিক এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে কোনো একাডেমিক সনদ পাওয়ার সুযোগ না থাকলেও শিক্ষা লাভের অভিজ্ঞতা অর্জন করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। আর এই শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগিয়ে সুশীল সমাজ গড়া,  দেশত্ববোধ, নিজেকে কু-অভ্যাস থেকে দূরে রাখা, সুন্দর জীবন গড়ার সুযোগ করে  দেয়া যেতে পারে। আর তা সম্ভব একমাত্র বই পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে।

জাতির উন্নতি নির্ভর করে তার সমাজের মেধাবী মানুষগুলোর উপর ভিত্তি করে। যে জাতি পৃথিবীতে বেশি চিন্তাশীল সে জাতিকে কেউ আজ পর্যন্ত দাবিয়ে রাখতে পারেনি। কি সাহিত্যে, কি রাজনীতিতে, কি অর্থনীতিতে। সব জায়গায়ই তারা তাদের উন্নতির বিকাশ ঘটিয়েছে। আর আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয় তা হলো জ্ঞানচর্চা কিন্তু আনন্দেরও বিষয়। কারণ নতুন নতুন কিছু জানার মধ্য দিয়ে আনন্দের অনেক খোরাক পাওয়া যায়।

বইয়ের জগতে যে জ্ঞান ও সুখের সাক্ষরতা পৃথিবীর অন্য কিছুতে নেই। এই জ্ঞান ও সুখের সজল পরশ না পেলে মানব জীবন সার্থক হয় না। মানুষ নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চায় আবার অন্যকেও জানতে চায় নিবিড় করে। এই জানা ও জানানোর আকাক্সক্ষা নিবারণের জন্যই বইয়ের জ্ঞান।

জ্ঞানার্জনে বইয়ের বিকল্প নেই। বইপ্রেমি/ পড়ুয়া পাতার পর পাতা উল্টে বিচিত্র আস্বাদ গ্রহণ  করে পরিতৃপ্ত হয়। মানুষ এই পৃথিবীকে সুন্দর থেকে সুন্দরতম করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। প্রয়াসগুলো মানুষ কর্ম ও লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করছে। গ্রন্থ অতীত ও বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একসূত্রে ধরে রাখার সেতুবন্ধন তৈরি করে। সমাজ ও জাতি গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বই।

বই হচ্ছে সভ্যতার স্মারক। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনাকে লালন করে বই। জাতীয় সংস্কৃতি, সভ্যতার ইতিহাস, ধর্ম-দর্শন, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি বইয়ের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে। তাই আমাদের জীবন চলার পথে বইয়ের মতো নীরব অন্তরঙ্গ বন্ধু আর দ্বিতীয়টি নেই। মানুষের বই পড়ার আগ্রহ বা পাঠাভ্যাস আর আগের মতো নেই। গ্রন্থাগার হারিয়ে ফেলেছে পূর্বের আকর্ষণ। নিজেদের ঐতিহ্যে আগ্রহ হারাচ্ছে যুব সমাজ। অপসংস্কৃতির প্রতি দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে বর্তমানে সমাজে মূল্যবোধের সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে পুনরায় বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হতে হবে।

জাতীয় জীবনে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুস্থ জীবনবোধ। আর এটি সম্ভব গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এবং সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে একটি জাতির বিকাশ ঘটে। আমাদের বিশ্বাসবোধ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব হয়েছে জ্ঞানচর্চার ফলে। এর সুফল আমরা পেয়েছি গ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে। বই পড়ে আমরা যদি জ্ঞানের অভাব দূর করতে পারি, তাহলে সম্পদের অভাবও আমাদের বেশি দিন থাকবে না। সেই জন্য আমাদের পাঠক হতে হবে, বইমনস্ক জাতি হতে হবে। পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সব ধরনের নেশায় অপকার আছে, বইয়ের নেশায় কোনো ক্ষতি নেই। কেননা বই নিজেই একটি মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠান।