বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

খালেদার বাড়িতে খাবার ও পানি সরবরাহ বন্ধ

images

বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তার গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ‘ফিরোজা’ নামক ভাড়া বাসার পানির লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। পুলিশ কাউকে বাসায় ঢুকতেও দিচ্ছে না। বেগম জিয়ার ভাইয়ের স্ত্রী গতকাল দুপুরে খাবার নিয়ে এসে দুই ঘণ্টা গেটে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেছেন। পুলিশের এক কথা ‘উপরের নির্দেশ’ কাউকে ঢুকতে দেয়া যাবে না। বিরোধীদলীয় নেতা সারাদিন কিছুই খাননি জানানোর পরও পুলিশের মন গলেনি। ‘উপরের নির্দেশ ভিতরে যেতে দেয়া যাবে না’ অবস্থানে অনঢ় তারা।
তিন বারের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে অভুক্ত রাখার অমানবিক সিদ্ধান্ত হতবাক দেশের মানুষ। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বেগম খালেদা জিয়ার খবর জানার জন্য গোটা দেশের মানুষ উদগ্রীব। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মানুষের মধ্যে অস্থিরতা খালেদা জিয়ার খবর কি? তার বাসায় পানি বন্ধ করা হলো কেন? কারো সঙ্গে দেখা হলেই জানতে চান খালেদা জিয়ার খবর কি? তাকে কি খেতে দেয়া হয়নি? একজন মানুষকে উপোষ রাখা কি কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ? তাকে কি গৃহবন্দী করা হচ্ছে? ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ উৎসুক মানুষের এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি। ‘বেগম জিয়ার বাসায় কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। বাড়ির পানির লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ছোটভাই শামীম ইস্কান্দারের স্ত্রী খাবার নিয়ে এসে দুই ঘণ্টা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছেন। খাবার ভিতরে নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার বসবাসরত বাসা (গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ি ‘ফিরোজা’) র‌্যাব-ডিবি-দাঙ্গা পুলিশ ঘিরে রেখেছে।’ এ খবর টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার পর খালেদা জিয়াকে নিয়ে সারাদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সবাই খালেদা জিয়ার খবর জানার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। পুলিশ কাউকে দাঁড়াতে না দিলেও বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ির আশপাশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে খবর জানার চেষ্টা করেন। দিল্লীর খুঁটির জোরের কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এ অমানবিক সাহস দেখাচ্ছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন।
ঘটনার সূত্রপাত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে। বিএনপির প্রেসিডিয়ামের তিন প্রবীণ সদস্যকে গ্রেফতারের পর দলের চেয়ারপার্সনের গুলশানের অফিস ও তাঁর বাড়ি ঘিরে রাখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর জানান, নাশকতা ঘটাতে পারেন সে অভিযোগে সাবেক তিন মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অতপর রাত ১টার সময় বেগম জিয়ার উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বেগম জিয়ার বাসা থেকে বের হয়ে এলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। টেলিভিশনে সচিত্র এ খবর দেখে মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যা এবং রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য, দ্বিতীয় সারির নেতা, যুব নেতার বাসায় পুলিশ প্রহরা এবং কারো কারো বাড়ি তল্লাশি করার খবর মিডিয়ায় আসায় উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্কের পাশাপাশি উৎকণ্ঠাও বাড়তে থাকে। সারাদেশে এখন থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। গতকাল দুপুরে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতার কঠোর বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচারের পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। সবাই খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেন বেগম খালেদা জিয়ার বাসার খরব কি। পুলিশ জানায় নিরাপত্তাজনিত কারণে বিরোধীদলীয় নেতার বাসায় পুলিশের প্রহরা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ কেতাবী কথায় আশ্বস্ত হতে পারেনি। তারা নেত্রীর খবর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। গ্রেফতারের ভয়ে আত্মগোপনে থাকায় বিএনপির সিনিয়র ও মাধ্যসারির নেতাদেরও পাওয়া যাচ্ছিল না। এ জন্য রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশের অনেকেই নেত্রীর খবর জানার চেষ্টায় গুলশানের কার্যালয়ে যান। সেখানেও বিপুল পরিমাণ পুলিশ প্রহরায় থাকায় চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে কেউ ঢুকতে পারেননি। তারা ছুটে যান নেত্রীর ৭৯ নম্বর রোডের বাসায়। যারা বাসার নম্বর জানেন না তারাও এর ওর কাছে ঠিকানা নিয়ে ছুটে যান। কিন্তু পুলিশ দূর থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়। কার্যত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছাড়া খালেদা জিয়ার বাসায় কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। সকাল থেকে না খেয়ে রয়েছেন জেনে বেগম জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা দুপুরে খাবার নিয়ে যান। তিনি দায়িত্বরত পুলিশকে জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন সকাল থেকে না খেয়ে রয়েছেন। তাকে খাবার দিতে হবে। তার অনেক অনুনয় বিনয়েও পুলিশের মন গলেনি। পুলিশ কোনো ভাবেই খালেদা জিয়ার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাকে বাসায় প্রবেশ করতে দেননি। পুলিশের এক কথা ‘উপরের নির্দেশ রয়েছে’ কাউকে ভিতরে যেতে দেয়া হবে না। দুই ঘণ্টা অবস্থান করে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে কানিজ ফাতেমা খাবার নিয়ে ফিরে যান। বিকালে দলের একাধিক ভাইস চেয়ারম্যান এবং কয়েকজন নেতা বেগম জিয়ার বসাভবনের সড়কের আশপাশে যান। পরিস্থিতি ‘চরম’ দেখে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবস্থান করে চলে যান। গ্রেফতারের আশঙ্কায় কেউ বাসার সামনে যাওয়ার সাহস দেখাননি।
পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ-র‌্যাব-এর পাহারা বসানো হয়েছে। পুলিশের অতিরিক্ত অবস্থানের কারণে গণমাধ্যম ও মিডিয়ার ব্যাপক সংখ্যক কর্মী বিরোধীদলীয় নেতার বাসার সামনে পালাক্রমে অবস্থান করছে। এদিকে গুলশানের ৮৬ সড়কের ৬ নম্বর চেয়ারপার্সনের কার্যালয় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘিরে রেখেছে। মিডিয়া কর্মীরা জানতে চান নিরাপত্তার সঙ্গে বাসার পানির লাইন বন্ধ করে দেয়া, কাউকে ঢুকতে না দেয়া এবং খাবার নিয়ে বাসায় প্রবেশ করতে না দেয়ার সম্পর্ক কি। সংবাদকর্মীদের এ সব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। তাদের বক্তব্য ‘উপরের নির্দেশ পালন করছে’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। খালেদা জিয়ার বাসায় পানির লাইন বন্ধ ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার পর সারাদেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের গালিগালাজ করছে। টান টান উত্তেজনায় সাধারণ মানুষ। সারাদেশে পুলিশের ধরপাকড়ের মধ্যেও হরতাল সমর্থকরা রাজপথের কর্মসূচি পালনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ অবস্থায় থেকেও বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, এদেশ থেকে গণতন্ত্রকে চিরতরে নির্বাসনে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। একতরফা নির্বাচন করে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার গোপন চক্রান্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বৈরাচারী শক্তির এ চক্রান্ত রুখতে হবে যে কোনো মূল্যে। গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে দেয়া বাণীতে তিনি দলমত নির্বিশেষে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। এ অবস্থায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার বলেছেন, শেখ হাসিনা কোনো সংলাপ বা দুইপক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে সংকটের নিরসন ঘটুক সেটা কখনই চাননি। পরিস্থিতি আরও অস্থির, সহিংস ও রক্তপাতে পিচ্ছিল হবার সম্ভাবনা প্রচুর। ১৮ দলীয় জোট এই ধরনের পরিস্থিতি কতোটা এড়াতে সক্ষম হবে বলা মুশকিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা দায় চাপাবে তাদের ওপর। দল হিসাবে বিএনপি বা আঠারো দলীয় জোটের সাংগঠনিক ক্ষমতা বা নেতৃত্বের শক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ বা বিচার্য নয়। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মোটেও কম শক্তিশালী নয়। দিল্লীর আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ বিরোধী এই ধারা আদর্শিক ও সাংগঠনিক এই উভয় দিক থেকেই দুর্বল হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিল্লীর পক্ষপাত এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, প্রকাশ হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ এই আন্দোলন-সংগ্রামকে দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হিসাবে বুঝবে। এটা ঠিক দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষেত্রে বিএনপির ওপর জনগণের ভরসা কম। তবে এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে। তাঁর দিল্লী¬ সফরের মধ্যে দিল্লীকে তুষ্ট করবার চিহ্ন দেখে জনগণ বিক্ষুব্ধ হলেও তারা মনে করে আঠারো দলীয় জোটের সম্মিলিত অবস্থান দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটা ঢাল হবে।
উৎসঃ   ইনকিলাব

Leave a Reply