শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ইংরেজী বছরের সূচনা ইতিহাস ও নতুন বছরের প্রত্যাশা

images885

মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ঃ-আমরা বাংলাদেশীরা বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি ইংরেজী নতুন বছরকেও বেশ ধূমধাম করে আনন্দের মাঝেই প্রতি বছর উদযাপন করে থাকি। আর একটু পরেই ২০১৩  সাল আমাদের জীবন থেকে চলে যাবে,চলে যাবে আরো একটি পুরানো বছর। দুঃখ কষ্ট ব্যথা যন্ত্রনা সবকিছুকে পিছনে ফেলে আবারো নতুন করে স্বাগত জানাবো আরো একটি নতুন বছর ২০১৪  সালকে। এই নতুন বছরে সবার চাওয়া থাকবে বিগত বছরের ভুলগুলো সব শুধরে নিয়ে এই বছরটিকে যেন আরো সুন্দর ও সাফল্যময় করে তুলতে পারি। এই বছরটি যেন জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বছরটি হয়। কিন্তু আনন্দ আর উল্লাসের মাঝে প্রিয়জনদেরকে নিয়ে শুরু হওয়া এই ইংরেজী বছরের সূচনা কেমন করে হয়েছিল তা আমরা অনেকেই জানিনা। জানিনা কিভাবে হয়েছিল এই আনন্দঘন মুহূর্তের জন্ম!পৃথিবীব্যাপী যতগুলো উৎসব পালন করা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো উৎসব হলো এই ইংরেজী বর্ষবরণ উৎসব। এই উৎসবের সূচনা হয় আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে। সে সময় মেসোপটেমীয় সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়েছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা। বর্তমানের ইরাককে প্রাচীনকালে বলা হতো মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আবার ৪টা আলাদা আলাদা ভাগ আছে, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। সে সময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালন করা হতো এই বর্ষবরণ। তবে সেটা কিন্তু এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না। তখন নিউইয়ার পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তকাল শীতকালের রুক্ষতাকে ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতিকে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলে। এই সময়ে গাছে গাছে নতুন পাতা দেখা দেয়। এসময়ে ফুলের কলিরা যেন হেসে উঠে । নতুন দিনে পাখীরাও গান গেঁয়ে উঠে পরম ভালোবাসায় । প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকেই তাঁরা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করেছিল। অবশ্য তখন তাঁরা চাঁদ দেখেই বছর গণনা করত । উৎসবের শুরু হতো চাঁদ দেখে। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো তাদের বর্ষবরণ উৎসব, চলতো টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের আবার আলাদা আলাদা তাৎপর্যও ছিল।ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন করা শুরু করে রোমানরা। রোমের উপাখ্যান খ্যাত প্রথম সম্রাট রোমুলাসই ৭৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য এই ক্যালেন্ডারও রোমানরা চাঁদ দেখেই বানিয়েছিলেন। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ওদের নববর্ষ ছিল ১লা মার্চ। তবে প্রথম দিকে ওদের ক্যালেন্ডারে মাস ছিল মাত্র ১০টা, ছিল না জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। সমস্যা ছিল আরও, রোমানদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিল না। ধীরে ধীরে চাঁদের বেড়ে উঠার ছবি দিয়ে ওরা মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করতো। চাঁদ ওঠার সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলতো ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলতো নুনেস। পরে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের ঝামেলা শেষ করে বসিয়ে দেন তারিখ। ফলে বছরে মোট ৩৫৫ দিন হয়।যেহেতু চাঁদের হিসাবে প্রতিমাসে দিন হয় সাড়ে ২৯টি। আর তাই চাঁদের হিসাব করায় তাদের বছরে ১০ দিন কম থেকে গিয়েছিল। এইভাবে বছর হিসাবের ফলে চাষীরা পড়লো সমস্যায়। পরে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সম্রাট সিজার চাঁদের হিসাব না করে, সূর্য দিয়ে হিসাব করে বছরকে ৩৬৫ দিনে এনে এই সমস্যার সমাধান করেন। অনেকে বলেন সেই সময়ে সূর্য দেখে প্রথমে ৩৬৫ দিনের নয়, ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন! রোমান সম্রাট জুলিয়ান সিজার লিপিইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রিক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিন করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ঘন্টা। ৩৬৫ দিন বছর হিসাব করা হলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করলে হিসাবের কোন গড়মিল হয় না। আর তাই মোসাজিনিস অতিরিক্ত একদিন যুক্ত করে এ বছরটির নাম করেন ‘লিপিইয়ার’। যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ঠিক করা হয়েছিল বর্ষবরণ হিসেবে পালন করা হবে ২৬ মার্চ তারিখটি। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে মানা হচ্ছিল না। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস যখন জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে স্থান দেন, তিনি ঠিক করে দেন, জানুয়ারির ১ তারিখ হলো বছরের প্রথম দিন। ওইদিনই হবে বর্ষবরণ। কিন্তু সে কথাও মানা হলো না। রোমানরা সেই আগের মতো মার্চের ১ তারিখেই বর্ষবরণ উৎসব করতে লাগলেন। পরে জুলিয়াস সিজার যখন ৩৬৫ দিনে বছরের ঘোষণা দেন, তখন আবার বলে দেন, মার্চে নয়, বছর শুরু হবে জানুয়ারির ১ তারিখে। উৎসবও সেইদিনই হবে। এরপরই বর্ষবরণ উৎসব মার্চ মাস থেকে চলে এলো জানুয়ারিতে।সেইসময়ে রোমান সাম্রাজ্যে এই ক্যালেন্ডার নিয়ে অনেক রকম ঝামেলা হয়েছিল। আর তাই কবে যে নতুন বছর শুরু হবে, সেটা ঠিকই করা যাচ্ছিল না। একেক সময় একেক জায়গায় একেক দিন নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালিত হতো।সিজারের ক্যালেন্ডারেও ছিল বেশকিছু সমস্যা । এই সমস্যার সমাধানে মাত্র ৪০০ বছর আগে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের পরামর্শ নিয়ে ক্যালেন্ডারটির সংস্কার করেন। তারই নাম অনুসারে ক্যালেন্ডারটির নামকরণ করা হয়েছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আর এটি বের করার পর এর সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে সকল জাতিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে। ফলে আগে যারা নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষবরণ উৎসব পালন করতো, তারাও এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানুয়ারির ১ তারিখই নববর্ষ হিসেবে পালন করে । বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল ১লা জানুয়ারির বর্ষবরণ উৎসব। একই দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানালেও বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতিও ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হয় দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।গ্রেট ব্রিটেনে এই গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয় ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে। আর এই ক্যালেন্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। আমরাও পহেলা বৈশাখের পাশাপাশি প্রতিবছর ১লা জানুয়ারিতেও বর্ষবরণ করি। এদিনও আমরা সারারাত আনন্দে মেতে উঠি। মেতে উঠি ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যতায়।যেহেতু প্রাচীন রোমানদের হাতেই এই ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি আর তাই ইংরেজী বছরের বারটি মাসের বেশীর ভাগই নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবতা বা সম্রাটের নামানুসারে।

জানুয়ারী-রোমান দেবতা জানো’স এর নামানুসারে ।
ফেব্রুয়ারী-ল্যাটিন শব্দ ফেব্রুয়া থেকে নেয়া হয়েছে যার অর্থ পবিত্র
মার্চ-রোমানদের যুদ্ধ দেবতা মার্সের নামানুসারে
এপ্রিল-ল্যাটিন শব্দ এপ্রিলিস নামানুসারে যার অর্থ খোলা
মে-বসন্তের দেবী মায়া’স নামানুসারে
জুন-বিবাহ এবং নারী কল্যাণের দেবী জুনো’র নামানুসারে
জুলাই- রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার-এর নামানুসারে
আগষ্ট-জুলিয়াস সিজারের পুত্র অগাস্টাস সিজারের নামানুসারে
সেপ্টেম্বর-ল্যাটিন সপ্তম সংখ্যা সেপ্টেম এর নামানুসারে
অক্টোবর- ল্যাটিন অষ্টম সংখ্যা অক্টো এর নামানুসারে
নভেম্বর- ল্যাটিন নবম সংখ্যা নভেম এর নামানুসারে
ডিসেম্বর- ল্যাটিন দশম সংখ্যা ডিসেম এর নামানুসারে

পরিশেষে- বছরের শুরুতে সবাই যেন মনে রাখি আমরা আমাদের স্বত্বাকে কোনভাবেই যেন বিসর্জিত না দেই। আনন্দ আর উল্লাসে সীমা অতিক্রম করে উগ্রতায় যেন মেতে না উঠি । যা বিপদ ডেকে আনবে, নিজেকে করবে হেয় এমন কিছুই যেন আমরা না করি। আমরা আমাদের অনৈতিক আচরন ও পশুত্বকে যেন বিদায়ী বছরের সাথেই জলাঞ্জলি দিয়ে দেশকে ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। এই হোক নতুন বছরে আমাদের সবার প্রতিজ্ঞা।
করুণাময়ের কাছে দুহাত তুলে বলি-‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জানা, অজানা, প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সব ধরনের পাপ ক্ষমা করে দাও। হে দয়াময়! নতুন এই বছরটিতে আমরা যেন নতুন উদ্যোমে সবাই একসাথে মিলেমিশে দেশের জন্য কাজ করতে পারি সেই তৌফিক তুমি আমাদেরকে দান কর… আমীন’।
সবাইকে
২০১৪  ইংরেজী নতুন বছরের অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা …!

 

[email protected]

Leave a Reply