বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

আগ্রাসন ইতিহাসে মাশরাফি

BD 720151112105930

খবরিকা ডেস্ক::ব্যাটসম্যান বোলারকে মোকাবিলা করছেন, তাকে ঘিরে ধরেছেন ফিল্ডাররা—ক্রিকেট আগ্রাসনের অন্যতম সেরা দৃশ্য এটি। এগারো জনের দলের আট-নয়জনই যদি ব্যাটসম্যানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে তিনি যত বড় দুঁদে ব্যাটসম্যানই হন না কেন চাপে পড়ে যেতে বাধ্যই।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যাটসম্যানকে চাপে ফেলে তাঁকে দুর্বল করে দেওয়ার এমন দৃশ্য টেস্ট ক্রিকেটে খুব বিরল না হলেও রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে সাধারণত খুব একটা দেখা যায় না। বুধবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডের শেষ লগ্নে মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিংয়ের বিপরীতে ঠিক এমনই একটা দৃশ্যপট তৈরি করলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।

১৯৯৯ সালে স্টিভ ওয়াহও ৯ ফিল্ডার দিয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাজিয়েছিলেন আগ্রাসী এক মুহূর্ত। ছবি: সংগৃহীত।জিম্বাবুয়ের শেষ উইকেটে মুজারাবানির বিরুদ্ধে পাঁচ স্লিপ আর তিন গালি নিয়ে বল করলেন মুস্তাফিজুর রহমান। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যাবে না বলেই নিজেদের মুঠোফোনে দৃশ্যটা ধরে রাখতে চাইলেন দর্শকেরা। মুজারাবানিকে ঘিরে ধরা আট বাংলাদেশি ফিল্ডার আর বোলার মুস্তাফিজের বল করতে দৌড়ে আসার প্রেক্ষাপটে গ্যালারিতে দর্শকদের মুঠোফোনের আলোর বর্ণচ্ছটা—সত্যিই এক অন্যরকম মুহূর্তেরই জন্ম হল বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানকে ঘিরে আছে প্রায় গোটা দল—এমন দৃশ্য তৈরি করতে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের জুড়ি মেলা ভার। কাল মাশরাফি যখন আগ্রাসী হয়ে উঠলেন, তখন থেকে থেকেই প্রসঙ্গ উঠল অস্ট্রেলিয়ার। বেশ অনেক দিন ধরেই এদেশের ক্রিকেটে নতুন দিন শুরু হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, কাল আগ্রাসনের দৃশ্যপটে নিজেদের মেলে ধরে বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা প্রমাণ করতে চাইলেন, নতুন দিনটা চলে এসেছে সত্যি সত্যিই।

২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইশান্ত শর্মাকে বল করছেন অ্যাডাম ভোজেস। তাঁকে ঘিরে আছে মাইকেল ক্লার্কের সাজানো অদ্ভুত এক ফিল্ডিং। ছবি: সংগৃহীত১৯৩২-৩৩ মৌসুমে সেই ‘কুখ্যাত’ অ্যাশেজ সিরিজে ইংলিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন ডন ব্র্যাডম্যানকে ঠেকাতে অদ্ভুতুড়ে এক ফিল্ডিংয়ের প্রদর্শনী ঘটিয়েছিলেন। লেগ সাইডে বেশির ভাগ ফিল্ডার রেখে হ্যারল্ড কাউকে ব্র্যাডম্যান ও অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের শরীর লক্ষ্য করে বল করতে বলেছিলেন তিনি। ক্রিকেট ইতিহাসে ‘লীগ থিওরি’ হিসেবে পরিচিত জামিনের এই কৌশল কাজে এসেছিল। ব্র্যাডম্যান তো ব্যর্থ হয়েছিলেনই, অস্ট্রেলিয়াও অ্যাশেজ তুলে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের হাতে। ‘বডিলাইন’ হিসেবে বেশি পরিচিত এই সিরিজে জামিন ক্রিকেট-আগ্রাসনের সবচেয়ে কুৎসিত চেহারাটি দেখিয়েছিলেন ‘আইনসিদ্ধ’ পথে হেঁটেই।

বডিলাইন সিরিজে নিজেরা এমন কিছুর শিকার হয়েই কিনা, আগ্রাসনের এই ব্যাপারটি অস্ট্রেলীয়দের মধ্যেই দেখা যায় বেশি। তবে ডলার জামিনের মতো প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে আহত করে ভড়কে দেওয়ার নোংরা ব্যাপারটা এতে থাকে না বললেই চলে। প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের কিছুটা উপহাস করার প্রয়াসটা কিন্তু এতে থেকেই যায়।

১৯৩২-৩৩ মৌসুমে বডিলাইন সিরিজে ইংলিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের সেই কুখ্যাত লেগথিওরি অনুসৃত ফিল্ডিং। ছবি: সংগৃহীতক্রিকেট ইতিহাসে চরম আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজানোর যে কয়েকটি মুহূর্ত আছে, সেখানে একাধিকবার এসেছে অস্ট্রেলীয়দের নাম। ১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে কিউইদের ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান পিটার প্যাথেরিককে আউট করতে স্লিপ ও গালি মিলিয়ে মোট ৯ জন ফিল্ডার রেখেছিলেন সে সময়কার অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল। নিশ্চিত জয় জেনে নিউজিল্যান্ডের এগারোতম ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে এমন ফিল্ডিং সাজানোকে কী বলা চলে আগ্রাসন নাকি উপহাস!

ম্যাট প্রায়রকে এমন ফিল্ডিং সাজিও ফেরাতে পারেননি নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম।১৯৯৯ সালে আরেক অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ ঠিক এমনটাই করেছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। হারারেতে সেই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে কাঁপছিল অস্ট্রেলিয়ার বোলিং দাপটে। সে ম্যাচে ডেমিয়েন ফ্লেমিংকে উইকেট উপহার দিতেই কিনা অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ স্লিপে আর গালিতে দাঁড় করালেন ৯ ফিল্ডারকে। লাল-জার্সি পড়া জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানের পেছনে সবুজ-হলুদ জার্সির ৯ ফিল্ডারের ঘেরাটোপ ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম দৃশ্য হয়ে আছে।

অস্ট্রেলীয়রা ঠিক এভাবেই ভারতীয় দলকে বিব্রত করেছিল ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ব্যাটিংয়ে ভারতের ইশান্ত শর্মা। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক গোটা দলকেই নিয়ে এলেন ইশান্ত শর্মার চারপাশে। উইকেটরক্ষক আর বোলার ছাড়াও সেদিন ইশান্তের আশপাশে ছিল অস্ট্রেলিয়ার ৩ স্লিপসহ একজন করে সিলি পয়েন্ট, লেগ স্লিপ, সিলি মিড অন আর শর্ট লেগ।

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার রাতের দৃশ্য। মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিংয়ে আট ফিল্ডার দিয়ে স্লিপ আর গালি ঘিরে রাখলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।এই তো সেদিন, ২০১৪-তে নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেস্টের একেবারে শেষ ওভারে ম্যাচটা জেতার জন্য ৮ ফিল্ডারকে ইংলিশ ব্যাটসম্যান ম্যাট প্রায়রের চারদিকে জরো করেছিলেন কিউই অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। সেদিন স্লিপে ছিলেন ২ জন, লেগ স্লিপে আরও ২ জন ফিল্ডার রাখলেন তিনি। পাশাপাশি থাকল ১টা করে শর্ট লেগ, সিলি মিড অন আর সিলি মিড অফ। প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও ম্যাচটা শেষ অবধি ড্র করতে পেরেছিলেন প্রায়র।

আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজানোর এই কয়েকটি ঘটনাকে ক্রিকেট ইতিহাসেরই ‘সেরা পাঁচ’ বলতে চান অনেকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কাল মাশরাফি ৮ ফিল্ডারের যে ‘ছাতা’ মেলে ধরলেন জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানের ওপর, তাকে আগ্রাসী ফিল্ডিংয়ের সেরা ঘটনাগুলোর পাশে আনা হোক বা না হোক, আগ্রাসনের দৃশ্যপটে মাশরাফিদের প্রবেশের এই গল্পগাথাই তো অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম দিয়ে দেয়।